মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান
ভূমিকা
ছয় মাস আগে, এপ্রিলের ১৯ তারিখ নারী সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদন দেখে সরকারপ্রধান তীব্র উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। গণমাধ্যমে এসেছে, নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, সেসব দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এটা শুধু নারীদের বিষয় নয়, সার্বিক বিষয়। এই প্রতিবেদন ছাপিয়ে বিলি করা হবে। এটা পাঠ্যবইয়ের মতো বই আকারে ছাপা হবে। দলিল হিসেবে অফিসে রেখে দিলে হবে না, মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দিতে হবে।’ [আজকের পত্রিকা (অনলাইন), ১৯ এপ্রিল]
তবে সরকারের তৈরি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পর্যালোচনার আওতায় নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা আসেনি। নারী সংস্কার কমিশন সংসদের আসন বাড়িয়ে ৬০০ করে ৩০০টি আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখার যে ‘অযৌক্তিক’ প্রস্তাব দিয়েছিল, তা-ও রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক কোনো পক্ষ গ্রহণ করেনি। [দেখুন, ‘দীর্ঘ আলোচনায়ও সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ও উচ্চকক্ষ নিয়ে মতৈক্য হয়নি’, প্রথম আলো (অনলাইন), ১৪ জুলাই ২০২৫]
এর প্রতিবাদে নারী অধিকার সংগঠনগুলো সরকার, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়েছে।
২ আগস্ট অনুষ্ঠিত একটি মতবিনিময় সভায় তাদের ক্ষিপ্ত মনোভাব পরিষ্কারভাবে জনগণের সামনে এসেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি বলেন, ‘দেশে এখন নারীবিরোধী জাগরণ দেখা যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে নারীবিরোধী যে অবস্থানকে লালন করা হচ্ছে, সেটা বন্ধ করতে হবে।’ কিছু দাবি তারা ঐকমত্য কমিশনের কাছে তুলে ধরারও সিদ্ধান্ত নেন। [‘নারী আসন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ’, প্রথম আলো (অনলাইন), ২ আগস্ট ২০২৫]
নারী সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং নারী অধিকার সংগঠনগুলোর তৎপরতা
নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরপর বিভিন্ন শ্রেণি ও পর্যায়ে তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনা হয়েছে। তবে সময় গড়াতে থাকলে অন্য সব ইস্যুর মতো এটি নিয়েও আলোচনা কমে গেছে। কিন্তু নারী সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং নারী অধিকার কর্মীরা বসে নেই। তারা নিয়মিত তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘নিরপেক্ষ’(!) ঐকমত্য কমিশনের লোকেরাও তাদের সমর্থন জোগাচ্ছেন।
গত ১০ আগস্ট ‘জাতীয় সংসদে নারী আসন ও নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে প্রথম আলো। সেখানে তারা কঠিন সুরে বলেন, ‘নারীর প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলের আচরণ পশ্চাৎগামী।… ঐকমত্য কমিশন ও দলগুলোর এই রক্ষণশীল অবস্থানের জন্য ভবিষ্যতে তাদের খেসারত দিতে হবে, জবাবদিহি করতে হবে।’ তাঁরা আক্ষেপ প্রকাশ করেন– ‘বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আশায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য বিলোপে সরকার ব্যর্থ।’
গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, প্রয়োজনে ঐকমত্য কমিশনের কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ারও দাবি ওঠে এই বৈঠকে।
আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমি অকপটে স্বীকার করছি, আমরা ব্যর্থ হয়েছি। পুরুষতন্ত্র জয়ী হয়েছে।’
৩ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সিডও দিবস উপলক্ষে ৭১টি সংগঠন নিয়ে গঠিত ‘সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি’ আরেকটি গোলটেবিল বৈঠক করে। আলোচনায় বক্তারা ‘নারীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ’ বা সিডও সনদের দুটি ধারা ২ ও ১৬ (গ)-এর ওপর বাংলাদেশ সরকারের সংরক্ষণ প্রত্যাহারের দাবি জানান। এটি নিয়ে সামনে আলোচনা আসছে।
১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে নারীর ‘রাজনৈতিক অধিকার ফোরাম’-এর পক্ষে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেন।
গত সপ্তাহে, অর্থাৎ ৪ অক্টোবর বদিউল আলম মজুমদার আরেকটি সভায় বলেন, ‘নারীদের অধস্তন রাখার দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই নারীদের যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।’ [প্রথম আলো (অনলাইন), ৪ অক্টোবর ২০২৫]
আমরা জানি না, সরকার ব্যবস্থাপনাগত কারণে, না অন্য কোনো কারণে নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার আওতাভুক্ত করেনি।
উক্ত মহলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ তুললেও, বাস্তবতা হল– সরকার ও কমিশন এমন প্রতিবেদন উপস্থাপন করে নাগরিকদের সাথে বৈষম্য ও তামাশার চূড়ান্ত করেছে এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর লালিত ও আচরিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে চরম আঘাত হেনেছে।
কাঠামোগত বৈষম্যের উদাহরণ
স্বৈরাচার সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের সাথে বৈষম্যের আচরণ করে অভ্যস্ত ছিল। সরকার পতনের পর দেশবাসী ভেবেছে, এবার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রকাশ্যে বৈষম্যের ধারা বন্ধ হবে। কিন্তু নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল– প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত বৈষম্য এখনো রয়ে গেছে।
সরকার নারী বিষয়ক সংস্কারের মতো নাযুক একটি বিষয়ে প্রস্তাবনা পেশ করা ও নীতি নির্ধারণের কমিশন প্রধান হিসেবে স্থির করেছে ৪২ বছর পুরোনো একটি ফেমিনিস্ট বা নারীবাদী সংগঠন ‘নারীপক্ষ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভিন হককে। কমিশনের জন্য এমনসব সদস্যই নির্বাচিত হয়েছেন, যারা নারীবাদী প্রজেক্টের সাথে শতভাগ একমত এবং এ দেশ ও জাতির আবহমান কাল থেকে চলে আসা সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন।
দেশের সুবিশাল জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন এই সদস্যরা প্রতিবেদনে নারীবাদী প্রকল্পের সবগুলো সুপারিশ-প্রস্তাব, মত ও দর্শন জাতির সামনে হাজির করেছে এবং সদর্পে বিষয়টি নিজেরাই প্রকাশ করেছে।
‘বাদ’ বা ‘ইজম’ একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার অনুসারীদের বোঝায়। সরকার সব মত ও পথের নারীর ওপর একটি চিহ্নিত গোষ্ঠীর মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে জনগণের সাথে কাঠামোগত বৈষম্যের উদাহরণই তৈরি করল। এই বৈষম্য জুলাই-পরবর্তী সরকারের কাছে জনগণ আশা করেনি।